
ছবি: ছবি: সংগৃহীত
বৃষ্টিপাত ও বৈরী আবহাওয়ায় থেমেছে উৎপাদন, মাঠে মজুদ ১৪ লাখ টন, বাজারে দাম বাড়ার সম্ভাবনা
কক্সবাজারের উপকূলজুড়ে লবণ উৎপাদনের মৌসুম শুরু হয়েছিল গত বছরের ৪ নভেম্বর থেকে। চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের মোট ৬৯ হাজার ১৯৮ একর জমিতে লবণ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২৬ লাখ ১০ হাজার মেট্রিক টন। কিন্তু বৃষ্টিপাত ও বৈরী আবহাওয়ার কারণে উৎপাদন কার্যক্রম সময়ের আগেই বন্ধ হয়ে গেছে। ১৭ মে পর্যন্ত শেষ পর্যন্ত উৎপাদিত হয়েছে ২২ লাখ ৫১ হাজার ৬৫১ মেট্রিক টন লবণ। এটি দেশের ইতিহাসে গত ৬৪ বছরে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ লবণ উৎপাদনের রেকর্ড।
বিসিক কক্সবাজার লবণ শিল্প উন্নয়ন প্রকল্পের উপমহাব্যবস্থাপক মো. জাফর ইকবাল জানান, মৌসুমের শেষ সময়ে হঠাৎ বৃষ্টিপাত শুরু হওয়ায় চাষিদের বেশিরভাগই মাঠ থেকে সরিয়ে নিয়েছেন তাদের উপকরণ। এরপর থেকেই পুরো উপকূলজুড়ে লবণ উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। মাঠ পর্যায়ে এখনো প্রায় ১৪ লাখ মেট্রিক টনের বেশি লবণ মজুদ রয়েছে যা দিয়ে আগামী ৭ থেকে ৮ মাসের ঘাটতি পূরণ সম্ভব।
চলতি মৌসুমে উৎপাদন ঘাটতি হয়েছে ৩ লাখ ৫৮ হাজার ৩৪৯ মেট্রিক টন। তবে বিসিক কর্তৃপক্ষ বলছে, এই ঘাটতি পূরণের জন্য আমদানির প্রয়োজন নেই। কারণ মাঠ পর্যায়ে পর্যাপ্ত পরিমাণে লবণ মজুদ রয়েছে।
বর্তমানে খোলা বাজারে প্রতি মণ লবণ বিক্রি হচ্ছে ২৭০ থেকে ২৮০ টাকায়, যার ফলে প্রতি কেজির দাম পড়ে সাড়ে ৬ থেকে ৭ টাকা। অথচ বাজারে প্যাকেটজাত লবণের খুচরা দাম ৩০ থেকে ৪৫ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। অথচ উৎপাদন খরচ তুলনায় অনেক বেশি — প্রতি মণ লবণ উৎপাদনে খরচ হচ্ছে ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা।
এতে প্রান্তিক চাষিরা পড়েছেন বিপাকে। বিসিক সূত্রে জানা যায়, কক্সবাজার অঞ্চলে প্রায় ৪১ হাজার ৩৫৫ জন প্রান্তিক চাষি এবং প্রায় ১ লাখ শ্রমিক সরাসরি লবণ উৎপাদন ও পরিবহনের সঙ্গে জড়িত। অনেকে মৌসুমের শুরুর দিকে খরচ করে মাঠে নামলেও উৎপাদন খরচ না ওঠায় হতাশ হয়েছেন।
২৪ মে বিকেলে কক্সবাজার সদরের খুরুশকুল উপকূলে গিয়ে দেখা গেছে, বৃষ্টির পানি জমে রয়েছে লবণের মাঠে। চাষিরা তাদের গর্তে রাখা লবণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যস্ত সময় পার করছেন। কেউ কেউ জমির পলিথিন তুলে ফেলেছেন আগেভাগেই, কেউ আবার গর্তের পানি ঢুকেছে কিনা তা যাচাই করছেন।
স্থানীয় চাষি নুরুল কবির বলেন, ‘‘বৃষ্টিপাত শুরু হলে একটানা সাত থেকে নয় দিন লবণ উৎপাদন বন্ধ রাখতে হয়। এবার এপ্রিলের শেষের দিকে এবং মে মাসে বৃষ্টির কারণে আমাদের মাঠ থেকে উঠতে হয়েছে। আবহাওয়া যদি ভালো থাকত আরও ২০ হাজার মেট্রিক টন লবণ উৎপাদন সম্ভব ছিল। কিন্তু এ বছর দামের কারণে আমরা হতাশ হয়েছি।’’
বিসিক লবণশিল্প উন্নয়ন প্রকল্পের মাঠ পরিদর্শক মো. ইদ্রিস আলী বলেন, ‘‘চলতি মৌসুমে এপ্রিল মাসে আবহাওয়া তুলনামূলক ভালো থাকলেও শুরুতে উৎপাদন কিছুটা কম ছিল। পরে চাষের খরচের চাপ ও দামের নিম্নমুখীতার কারণে অনেকে মাঠে নামতে দেরি করেছেন, আবার অনেকে উৎপাদন শেষ হওয়ার আগেই মাঠ ছেড়েছেন।’’
তিনি আরও জানান, মাঠ পর্যায়ে প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী প্রায় ১৪ লাখ মেট্রিক টন লবণ চাষিদের হাতে অবিক্রীত অবস্থায় রয়েছে। এ লবণ গর্তে, রাস্তার পাশে কিংবা মিলে মজুদ রয়েছে। চূড়ান্ত জরিপের কাজ চলমান রয়েছে এবং দু-এক দিনের মধ্যেই সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান পাওয়া যাবে।
এদিকে প্রান্তিক চাষিরা আশায় বুক বেঁধেছেন বর্ষা মৌসুমে দাম বাড়ার। খোলা বাজারে দাম বাড়লে হয়তো তারা কিছুটা ঘাটতি পুষিয়ে নিতে পারবেন। লবণ উৎপাদনের মৌসুম শুরু হবে আগামী নভেম্বর কিংবা ডিসেম্বর থেকে।
বিসিকের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, আগামী মৌসুমে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা পূরণের পাশাপাশি চাষিদের জন্য সহায়তা বাড়ানোর পরিকল্পনা গ্রহণ করা হবে। বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় লবণ মাঠ উন্নয়নে নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার, পানিনিষ্কাশন ব্যবস্থা, এবং উৎপাদন খরচ হ্রাসের দিকে নজর দেওয়া হবে।
লবণ উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত শ্রমিকরাও জানান, মৌসুমে কাজ না থাকায় তারা এখন বিকল্প কর্মসংস্থানের চিন্তা করছেন। তবে বর্ষা মৌসুম শেষে আবার মাঠে নামার প্রস্তুতি নিতে শুরু করবেন। লবণ উৎপাদন শুধু অর্থনৈতিক চাকা নয়, এটি উপকূলের জীবিকার প্রধান অবলম্বন বলেই মনে করছেন তারা।
সব মিলিয়ে উৎপাদনের দিক থেকে বছরটি রেকর্ড গড়লেও চাষিদের আয়ের দিক থেকে হতাশাজনকই বলা চলে। বাজার ব্যবস্থাপনা ও প্রণোদনা না বাড়ালে আগামী মৌসুমে অনেক চাষিই হয়তো পেশা বদলের কথা ভাববেন। সংশ্লিষ্টদের মতে, সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে চাষিদের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করলেই এই শিল্প টেকসইভাবে এগিয়ে যাবে।
repoter