
ছবি: ছবি: সংগৃহীত
করোনার সংক্রমণ বাড়তেই কৃত্রিম সংকট তৈরি করে মাস্কের দাম বাড়িয়েছে অসাধু ব্যবসায়ীরা
দেশজুড়ে আবারও বাড়তে শুরু করেছে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ। এতে একদিকে জনমনে নতুন করে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে, অন্যদিকে এর সুযোগ নিয়ে আবারও সক্রিয় হয়ে উঠেছে ‘মাস্ক সিন্ডিকেট’। বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে মাস্কের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী ও উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান। মাস্কের ঘাটতির কারণে যেমন জনস্বাস্থ্য হুমকির মুখে পড়ছে, তেমনি সাধারণ মানুষকে অতিরিক্ত মূল্য গুনতে হচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সর্বশেষ সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে দুজনের মৃত্যু হয়েছে এবং নতুন করে শনাক্ত হয়েছেন ১৫ জন। এই সময়ের মধ্যে ১৭৪টি নমুনা পরীক্ষা করে ৮ দশমিক ৬২ শতাংশ শনাক্তের হার পাওয়া গেছে। মৃতদের একজনের বয়স ২১ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে এবং অন্যজনের বয়স ৭১ থেকে ৮০ বছরের মধ্যে। একজন ঢাকা বিভাগে এবং অন্যজন চট্টগ্রাম বিভাগে মারা গেছেন। দুজনের একজন সরকারি হাসপাতালে এবং অপরজন বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, করোনার বর্তমান ধরন আগের তুলনায় অপেক্ষাকৃত মৃদু হলেও এটি এখনও বয়স্ক এবং রোগপ্রবণ মানুষদের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে। ফলে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা এবং মাস্ক পরিধানের প্রয়োজনীয়তা আবারও সামনে চলে এসেছে।
এই পরিস্থিতির মধ্যেই মাস্কের বাজারে কৃত্রিম সংকট দেখা দিয়েছে। রাজধানী ঢাকা এবং দেশের বিভিন্ন এলাকায় মাস্কের চাহিদা হঠাৎ করে বেড়ে যাওয়ায় এক শ্রেণির ব্যবসায়ী পণ্যমজুতে মেতে উঠেছেন। ওষুধ কোম্পানিগুলোও মাস্কের সরবরাহ সীমিত করে রেখেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
মাস্কের দাম বেড়ে যাওয়ায় ভোক্তাদের মধ্যে চাপা আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। রাজধানীর মিটফোর্ড, চকবাজার, সূত্রাপুর ও গেন্ডারিয়া এলাকার পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অল্প কিছুদিন আগেও যে মাস্কের ৫০ পিসের একটি বক্স ১০০ টাকায় পাওয়া যেত, সেটি এখন ১৪০ থেকে ১৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। খুচরা পর্যায়ে এই দাম বেড়ে ১৮০ থেকে ২০০ টাকায় দাঁড়িয়েছে। একই সঙ্গে এন-৯৫ মাস্কের দামও বেড়েছে দ্বিগুণ। আগে ১০ টাকা দরে বিক্রি হওয়া মাস্ক এখন ২০ টাকা পিস দরে বিক্রি হচ্ছে।
সূত্রাপুরের একটি ফার্মেসির মালিক রাহুল পাল বলেন, “বেশ কয়েকদিন আগে স্কয়ার কোম্পানির সেপনিল মাস্ক অর্ডার দিয়েছি, এখনও পাইনি। মাস্কের চাহিদা বেড়েছে, কিন্তু কোম্পানিগুলো সরবরাহ করছে না। যে মাস্ক আগে ১০০ টাকায় পেতাম, এখন ১৫০ টাকায় কিনতে হচ্ছে, তবুও জোগান মিলছে না।”
২০২০ সালে প্রথম দফার সংক্রমণের সময়ও একই ধরনের সিন্ডিকেট বাজারে সক্রিয় ছিল। অতিরিক্ত দাম, নিম্নমানের মাস্ক এবং ভুয়া সনদ লেখা পণ্য সে সময় বাজার সয়লাব করেছিল। এবারও বাজারে ছড়িয়ে পড়েছে কিছু সন্দেহজনক কোম্পানির মাস্ক, যেগুলোর গায়ে ‘আইএসও’ বা ‘সিই’ সনদের উল্লেখ থাকলেও তা যাচাইয়ের কোনো উপায় নেই।
২০২০ সালের ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনাভাইরাস শনাক্ত হওয়ার পর পরিস্থিতি দ্রুত অবনতির দিকে গিয়েছিল। সে সময় কঠোর লকডাউন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ এবং হাসপাতালগুলোতে তীব্র চাপ তৈরি হয়। ২০২১ সালে ডেলটা ভ্যারিয়েন্টে মৃত্যুহার বেড়ে যায় এবং প্রতিদিন শতাধিক মানুষ মারা যেতে থাকেন। পরে ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট কিছুটা স্বস্তি দিলেও মাঝেমধ্যে নতুন উপধরনের কারণে সংক্রমণ আবারও বাড়ছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০২৩ সালের মে মাসে করোনাকে বৈশ্বিক জরুরি অবস্থা হিসেবে আর বিবেচনা না করলেও বিশেষজ্ঞরা বারবার সতর্ক করে দিচ্ছেন, ভাইরাসটি এখনও বিদ্যমান এবং মাঝে মাঝে রূপ পরিবর্তন করে ফিরে আসছে।
এই প্রেক্ষাপটে মাস্কের বাজারে নজরদারি না থাকা নিয়ে উঠেছে সমালোচনা। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর কিংবা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত মাস্ক বাজারে কোনো অভিযান বা তদারকির খবর পাওয়া যায়নি। কোনো ওয়েবসাইটে মাস্কের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্যও নির্ধারণ করা হয়নি, ফলে সাধারণ মানুষ বাধ্য হয়ে অতিরিক্ত দামে মাস্ক কিনছেন।
ফার্মেসিতে মাস্ক কিনতে আসা এক ক্রেতা তৌহিদুল ইসলাম বলেন, “খবরে দেখছি করোনার প্রকোপ বাড়ছে। তাই মাস্ক কিনতে এসেছিলাম, কিন্তু দেখি মাস্ক নেই। যেটুকু আছে, সেটার দাম অনেক বেশি। বাড়তি দাম দিলেও মাস্ক পাচ্ছি না।”
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাস্ক হচ্ছে করোনার বিরুদ্ধে এক প্রাথমিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা। সরকারকে এখনই কঠোরভাবে বাজার তদারকি করতে হবে, যাতে মাস্ক সিন্ডিকেট পুনরায় সক্রিয় হয়ে জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি না হয়ে ওঠে। একই সঙ্গে হাসপাতাল প্রস্তুতি, সচেতনতা কার্যক্রম এবং গণমাধ্যমে নিয়মিত তথ্য প্রকাশের ওপর জোর দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, দেশে এখন পর্যন্ত করোনাভাইরাসে ২৯ হাজার ৫০২ জন মানুষ মারা গেছেন এবং মোট শনাক্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২০ লাখ ৫১ হাজার ৮০০ জনে।
করোনার নতুন করে বাড়তি সংক্রমণের এই সময়ে সরকারের সঠিক তদারকি ও প্রস্তুতির অভাব ভোক্তাদের ভোগান্তির পাশাপাশি দেশে নতুন করে স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক সংকট সৃষ্টি করতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
repoter