
ছবি: ছবি: সংগৃহীত
ঢাকার চাঁনখারপুলে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সাবেক ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার হাবিবুর রহমানসহ ৮ জনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে প্রথম তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে। সোমবার (২১ এপ্রিল) এক সংবাদ সম্মেলনে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ তাজুল এ তথ্য জানান।
তিনি বলেন, ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে ঢাকার চাঁনখারপুল এলাকায় এক শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের সময় এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। দীর্ঘ ১৯৫ দিনের তদন্ত শেষে ৯০ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনটি রবিবার ট্রাইব্যুনালে জমা দেওয়া হয়। এ ঘটনাটি মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের আওতায় বিচারযোগ্য অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।
তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই ঘটনায় নিহত হয়েছেন শাহরিয়ার খান আনাস, শেখ মাহদি হাসান জুনায়েদ, মো. ইয়াকুব, মো. রাকিব হাওলাদার, মো. ইসমামুল হক এবং মানিক মিয়া শাহরিক। এদের প্রত্যেকেই ছিলেন আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী নিরস্ত্র নাগরিক। চাঁনখারপুল এলাকায় তারা শান্তিপূর্ণভাবে অবস্থান করছিলেন, যেখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা সরাসরি প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করে তাদের হত্যা করে।
গ্রেপ্তার হওয়া চারজন আসামির মধ্যে রয়েছেন ইন্সপেক্টর আরশাদ, কনস্টেবল মো. সুজন, কনস্টেবল ইমাজ হোসেন ইমন এবং কনস্টেবল নাসিরুল ইসলাম। বাকিরা পলাতক, তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন তৎকালীন ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান। প্রসিকিউটর জানান, অভিযুক্তদের কেউ কেউ ঘটনাস্থলে সরাসরি উপস্থিত ছিলেন এবং কেউ কেউ ঘটনাকে তদারকি করছিলেন। তদন্তে উঠে এসেছে, পলাতক সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমানসহ অন্য অভিযুক্তরা এই হত্যাকাণ্ডে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। তারা তাদের অধীনস্থদের এমন অপরাধ থেকে বিরত রাখেননি বরং বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেছেন।
প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম আরও জানান, তদন্তে মোট ৭৯ জন সাক্ষীর জবানবন্দি গ্রহণ করা হয়েছে। এ ছাড়া প্রমাণ হিসেবে প্রতিবেদনের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়েছে ১৯টি ভিডিওচিত্র, ১১টি পত্রিকার প্রতিবেদন, ২টি অডিও রেকর্ডিং, ১১টি বই ও রিপোর্ট এবং ৬টি মৃত্যুসনদ।
এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে ছিল পরিকল্পিত দমননীতি। প্রতিবাদী জনতার কণ্ঠরোধে উদ্দেশ্যমূলকভাবে এই অভিযান পরিচালনা করা হয় বলে অভিযোগ উঠে এসেছে। শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে অংশ নেওয়া নাগরিকদের লক্ষ্য করে যেভাবে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে, তা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন এবং মানবতাবিরোধী অপরাধ সংক্রান্ত আইন অনুযায়ী গুরুতর অপরাধের আওতায় পড়ে।
প্রসিকিউটর জানান, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্তব্য নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হলেও এই ঘটনার ক্ষেত্রে তা পাল্টে যায় হত্যাকাণ্ডে। অভিযুক্তরা কোনো ধরনের বৈধ নির্দেশনাও পালন করেননি এবং পরবর্তীতে তারা এই বর্বরোচিত ঘটনার দায় এড়াতে উদ্যোগও নেননি। এসব কর্মকাণ্ড স্পষ্টভাবে মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে গণ্য হচ্ছে।
তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার মাধ্যমে এই ঘটনার আইনি প্রক্রিয়া নতুন একটি ধাপে প্রবেশ করল। আগামী দিনে এ বিষয়ে শুনানি ও বিচার কার্যক্রম শুরু হবে বলে আশা করা হচ্ছে। চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয় থেকে জানানো হয়েছে, এ মামলায় অভিযুক্তদের বিচারের মুখোমুখি করার জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে।
এটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের ইতিহাসে এমন একটি সময়কালীন মামলার প্রথম আনুষ্ঠানিক তদন্ত প্রতিবেদন, যেখানে সমসাময়িক হত্যাকাণ্ডের বিচার প্রক্রিয়া শুরু হচ্ছে। মানবাধিকার রক্ষা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এ ধরনের পদক্ষেপ আইন প্রয়োগকারী সংস্থার জবাবদিহিতা নিশ্চিত করবে বলেও মত দিয়েছেন বিশ্লেষকরা।
repoter