
ছবি: ছবি: সংগৃহীত
অবশেষে ‘ভৌগোলিক নির্দেশক’ (জিআই) পণ্যের স্বীকৃতি পেল কুমিল্লার ঐতিহ্যবাহী খাদি কাপড়। দীর্ঘদিনের অপেক্ষার পর এই সম্মাননা পেয়ে উচ্ছ্বসিত স্থানীয় তাঁতী, ব্যবসায়ী এবং কুমিল্লাবাসী। শিল্প মন্ত্রণালয়ের পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্ক অধিদপ্তর ঢাকায় আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বুধবার কুমিল্লার খাদিসহ মোট ২৫টি পণ্যের হাতে আনুষ্ঠানিকভাবে জিআই সনদ হস্তান্তর করে।
এ স্বীকৃতি ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ হিসেবে বিবেচিত খাদি শিল্পকে নতুনভাবে পরিচিত করে তুলেছে। স্থানীয়দের বিশ্বাস, এই সনদ শুধু কুমিল্লার গৌরবই বাড়াবে না, একই সঙ্গে এই শিল্পের অর্থনৈতিক সম্ভাবনাও নতুনভাবে উন্মোচিত করবে। তাঁত শিল্পের সঙ্গে জড়িত অনেকেই মনে করেন, এখন সময় এসেছে খাদিকে আবার প্রাণ ফিরিয়ে দেওয়ার।
দেবীদ্বার উপজেলার প্রবীণ তাঁতী চিন্তাহরণ দেবনাথ বলেন, খাদি আমাদের রক্তে মিশে আছে। পূর্বপুরুষদের হাতের গড়া এই শিল্প এক সময় গ্রামীণ জীবনের অন্যতম অঙ্গ ছিল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তুলার সংকট, দক্ষ শ্রমিকের অভাব এবং মেশিনলুমের প্রভাবের কারণে এই শিল্প প্রায় বিলুপ্তির পথে। এখনকার দিনে হাতে তৈরি তাঁতের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে কমে এসেছে। তিনি বলেন, সরকারি ভর্তুকি এবং সহযোগিতা ছাড়া তাঁতের ঘরে সাড়া ফেরা সম্ভব নয়।
খাদি কাপড়ের ঐতিহাসিক গুরুত্বের কথা উল্লেখ করে বলা হয়, ১৯২১ সালে মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত ‘স্বদেশি আন্দোলন’-এর সময় খাদি জাতীয় প্রতীকে রূপ নেয়। এই আন্দোলনের সূত্রে খাদির উৎপাদন এবং ব্যবহার ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। তখন থেকেই খাদি শুধু একটি কাপড় নয়, বরং একটি রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রতীক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। হাতে কাটা সুতা দিয়ে তৈরি হওয়ায় খাদি পরিবেশবান্ধব এবং আরামদায়ক পোশাক হিসেবে এখনো জনপ্রিয়।
কুমিল্লার খাদি তৈরির ঐতিহ্য এবং খ্যাতি দেশজুড়ে যেমন বিস্তৃত, তেমনি তা বিদেশেও জনপ্রিয়তা পেয়েছে। কুমিল্লা খাদিঘরের মালিক প্রদীপ কুমার রাহা বলেন, দেশি-বিদেশি ক্রেতাদের কাছে কুমিল্লার খাদির চাহিদা বরাবরই ভালো। তিনি আশা প্রকাশ করেন, জিআই স্বীকৃতি খাদির জন্য আন্তর্জাতিক রপ্তানি বাজারে নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দেবে। তার মতে, যদি সঠিকভাবে বাজারজাত করা যায় এবং নীতিনির্ধারকরা সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন, তবে কুমিল্লার খাদি আন্তর্জাতিক পোশাক ব্র্যান্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে পারে।
চান্দিনা ও দেবীদ্বার অঞ্চলের তাঁতিরা জানান, একসময় এই এলাকাগুলোতে শত শত তাঁত ছিল। খাদির কদর থাকায় তাঁতিদের জীবিকাও ছিল স্থিতিশীল। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনে এবং আধুনিক প্রযুক্তির আগমনে মেশিনলুম খাদি বাজার দখল করে নেয়, যা হাতে তৈরি খাদির অস্তিত্ব সংকটে ফেলে। তাঁতিদের মতে, এই অবস্থা থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা এবং প্রণোদনা।
কুমিল্লার জেলা প্রশাসক মো. আমিরুল কায়ছার জানান, কুমিল্লার তিনটি পণ্যকে জিআই স্বীকৃতির জন্য উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে গত বছর কুমিল্লার রসমালাই জিআই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয় এবং এবার খাদি কাপড় সেই সম্মাননা পেল। তিনি আরও বলেন, বিজয়পুরের মৃৎশিল্পকেও জিআই স্বীকৃতির আওতায় আনতে জেলা প্রশাসন কাজ করে যাচ্ছে।
জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা জানান, জিআই স্বীকৃতি শুধু কোনো পণ্যের সম্মানই বৃদ্ধি করে না, বরং তা অর্থনৈতিকভাবে ওই অঞ্চলের মানুষের জীবনমান উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কুমিল্লার খাদি ইতোমধ্যে একটি নিজস্ব পরিচিতি গড়ে তুলেছে, যা এখন রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেয়েছে। এই স্বীকৃতির ফলে স্থানীয় উৎপাদকরা যেমন উৎসাহিত হবেন, তেমনি নতুন প্রজন্মও এই শিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে আগ্রহী হবে।
স্থানীয় জনগণ, ব্যবসায়ী এবং সংস্কৃতি সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, জিআই স্বীকৃতির ফলে কুমিল্লার খাদি শুধু দেশীয় বাজারেই নয়, বরং আন্তর্জাতিক বাজারেও একটি ভিন্ন মাত্রায় পৌঁছাবে। তারা আশা করছেন, এখন সময় এসেছে খাদি শিল্পকে নতুন করে গড়ে তোলার, যাতে এ ঐতিহ্যবাহী পণ্য আবারও তাদের স্বর্ণযুগে ফিরে যেতে পারে।
repoter