
ছবি: ছবি: সংগৃহীত
চুয়াডাঙ্গায় প্রতিষ্ঠিত দেশের অন্যতম সরকারি ছাগল উন্নয়ন খামারটি দীর্ঘদিন ধরেই জনবল সংকটে কার্যত অচল অবস্থায় রয়েছে। ১৯৯৬ সালে ব্ল্যাক বেঙ্গল জাতের ছাগলের সংরক্ষণ ও উন্নয়নের লক্ষ্যে গড়ে ওঠা এ খামারে বর্তমানে ১৩টি পদের মধ্যে ১১টিই শূন্য। উদ্বেগজনকভাবে খামারটি প্রতিষ্ঠার পর থেকে একদিনের জন্যও নিয়োগ দেওয়া হয়নি ভেটেরিনারি সার্জনের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে। ফলে খামারের কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে, যা ব্ল্যাক বেঙ্গল জাতের ভবিষ্যৎকেও হুমকির মুখে ফেলেছে।
জানা যায়, বিশ্বজুড়ে ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের মাংস ও চামড়ার বিশেষ কদর থাকলেও চুয়াডাঙ্গার এই খামারে প্রতিবছরই উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে খামারে ছাগলের সংখ্যা ছিল গত অর্থবছরের তুলনায় ১২২টি কম। খামারে রিসার্চ সেন্টার ও কৃত্রিম প্রজনন কেন্দ্র গড়ে তোলার পরিকল্পনা থাকলেও তা এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। ফলে জাত সংরক্ষণ ও প্রজনন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সংশ্লিষ্টদের আশঙ্কা, দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া না হলে এই সরকারি খামারটির অস্তিত্বই বিলীন হয়ে যেতে পারে।
স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, ব্ল্যাক বেঙ্গল জাতের ছাগল পালনে দেশের বহু নারী-পুরুষ ও তরুণ উদ্যোক্তা স্বাবলম্বী হয়েছেন। চুয়াডাঙ্গাসহ পার্শ্ববর্তী জেলাগুলোর প্রাণিসম্পদ বিভাগ খামারিদের সব ধরনের সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে। এমন একটি জাত যার রোগবালাই কম, উৎপাদনক্ষমতা বেশি—তা রক্ষায় সরকারি এই খামারটি যথাযথ ভূমিকা পালন করতে পারছে না কেবল জনবল সংকটের কারণে।
খামারটি শুরু হয়েছিল ১০ একর জমির ওপর, ২২৫টি মা ছাগী ও ৫০টি পাঠা নিয়ে। বর্তমানে সেখানে ছাগল সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৮৮টিতে। কিন্তু ২৯ বছর পেরিয়ে গেলেও কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য পূরণে ব্যর্থ হয়েছে খামারটি। অব্যবস্থাপনা, জনবল সংকট ও দীর্ঘসূত্রতা—সব মিলিয়ে এখন এ খামার কার্যত এক ভারসাম্যহীন প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।
খামারের নিজস্ব ৪ একর জমিতে নানা জাতের ঘাস যেমন—নেপিয়ার, রেড নেপিয়ার, সরগম ও ভুট্টা—রোপণ করা হয়, যা ছাগলের খাবারের চাহিদা পূরণে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু ঘাস উৎপাদন যথেষ্ট হলেও প্রাণিসম্পদ সেবা, চিকিৎসা ও প্রজনন সহায়তা দিতে না পারায় খামারটি পূর্ণ সম্ভাবনার সদ্ব্যবহার করতে পারছে না।
২০২৪ সালে ব্ল্যাক বেঙ্গল জাতের ছাগল ‘ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য’ (জিআই) হিসেবে স্বীকৃতি পায়, যা একে জাতীয় সম্পদের মর্যাদা দিয়েছে। বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট এ জাতের ছাগলের জীবন রহস্য উদঘাটন করে। এতে জাত সংরক্ষণে নতুন দিগন্তের উন্মোচন হলেও চুয়াডাঙ্গার এই খামার সে সম্ভাবনার ছোঁয়াও পাচ্ছে না।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, খামারে ১৩টি অনুমোদিত পদের মধ্যে কেবল প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা এবং হিসাবরক্ষক কাম ক্যাশিয়ার পদে কর্মরত আছেন। একটি করে উপ-সহকারী প্রাণীসম্পদ কর্মকর্তা, অফিস সহকারী, ছয়টি গোট অ্যাটেনডেন্ট এবং দুটি নৈশ প্রহরীর পদ দীর্ঘদিন ধরেই শূন্য রয়েছে। বর্তমানে গোট অ্যাটেনডেন্টের দায়িত্ব সাময়িকভাবে পালন করছেন ভোমরা স্থলবন্দর ও দামুড়হুদা এলাকা থেকে প্রেষণে আসা দুজন কর্মচারী।
খামারে বর্তমানে থাকা ছাগলের মধ্যে রয়েছে ৩৩টি প্রাপ্তবয়স্ক পাঠা, ৫১টি বাড়ন্ত পাঠা, ১৩০টি প্রাপ্তবয়স্ক ছাগী, ৬২টি বাড়ন্ত ছাগী, ৪৫টি পুরুষ বাচ্চা এবং ৬৭টি স্ত্রী বাচ্চা। এই সংখ্যা দিয়ে একটি কার্যকর জাত উন্নয়ন ও গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করা কঠিন বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
২০১৭-১৮ অর্থবছর থেকে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের মার্চ পর্যন্ত খামার থেকে বিতরণ করা হয়েছে ১০৩৫টি পাঠা এবং ৮৯৩টি ছাগী। তবে এই বিতরণ কার্যক্রমও জনবল সংকট ও প্রযুক্তির অভাবে নিয়মিতভাবে পরিচালনা করা যাচ্ছে না।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ছাগল উৎপাদন ও প্রজনন সংক্রান্ত গবেষণা কেন্দ্র চালু হলে ব্ল্যাক বেঙ্গল জাতের উৎকর্ষতা আরও বাড়ানো সম্ভব। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতায় সে সম্ভাবনা অধরাই থেকে যাচ্ছে। খামারটিকে যদি একটি আধুনিক গবেষণা ও উৎপাদন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা যায়, তাহলে দেশের অর্থনীতিতে এটি আরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে।
চুয়াডাঙ্গার ছাগল উন্নয়ন খামার কেবল একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান নয়, এটি একটি জাতের ভবিষ্যৎ সংরক্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। সময়মতো কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে, একসময় হয়তো হারিয়ে যাবে এই দুষ্প্রাপ্য ও লাভজনক ছাগলের জাত। সংশ্লিষ্টদের প্রত্যাশা, দ্রুত পদগুলোতে নিয়োগ দিয়ে খামারকে আবারও তার মূল লক্ষ্যে ফিরিয়ে আনা হবে।
repoter