
ছবি: ছবি: সংগৃহীত
স্থল নিম্নচাপের প্রভাবে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে ডুবে যাচ্ছে কক্সবাজারের উপকূলীয় এলাকা, বিচ্ছিন্ন সেন্টমার্টিন দ্বীপ, ঝুঁকিতে বেড়িবাঁধ ও হাজারো মানুষের জীবন
স্থলভাগে সৃষ্টি হওয়া নিম্নচাপের প্রভাবে কক্সবাজার উপকূলে বিরাজ করছে ভয়াবহ দুর্যোগ পরিস্থিতি। সমুদ্র উত্তাল, প্রবল জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হয়েছে অন্তত ৫০টি গ্রাম। সবচেয়ে বেশি বিপর্যস্ত হয়েছে কক্সবাজারের উপকূলবর্তী এলাকা ও প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন।
কক্সবাজার আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, নিম্নচাপের ফলে সাগরে সঞ্চালনশীল মেঘমালার সৃষ্টি হয়েছে এবং উপকূলজুড়ে দমকা ও ঝোড়ো হাওয়া বইছে। এর জেরে উপকূলে তিন নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত জারি আছে। শুক্রবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় কক্সবাজারে ১৫২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে, যা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি।
শুক্রবার সকালে কক্সবাজারের সুগন্ধা পয়েন্টে গিয়ে দেখা যায় উত্তাল সাগর এবং উচ্চমাত্রার জোয়ারের প্রভাব। জোয়ারের পানিতে উপকূলের অনেক দোকান ও কাঠামো ভেঙে গেছে, ট্যুরিস্ট পুলিশের বক্সগুলো পানিতে তলিয়ে গেছে। এ সময় শত শত পর্যটক সমুদ্রের ভয়ঙ্কর রূপ উপভোগ করতে উপকূলে ভিড় করলেও তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে নিরলস চেষ্টা করছে লাইফ গার্ড ও ট্যুরিস্ট পুলিশ।
সী সেফ লাইফ গার্ড সংস্থার ইনচার্জ মোহাম্মদ শুক্কুর জানান, সৈকতের মাদ্রাসা পয়েন্ট থেকে শুরু করে শৈবাল পয়েন্ট পর্যন্ত বহু ঝাউগাছ উপড়ে গেছে। লাবনী ও সুগন্ধা পয়েন্টে সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা, দোকানপাট পানির তোড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কলাতলী পয়েন্টেও একই অবস্থা বিরাজ করছে।
পর্যটকদের সচেতন করতে বারবার মাইকিং করা হলেও অনেকে তা উপেক্ষা করছেন বলে জানান শুক্কুর। পর্যটকদের নিরাপদে রাখতেই তারা নিরবিচারে কাজ করছেন।
কক্সবাজার জেলার অন্তর্ভুক্ত কুতুবদিয়া, মহেশখালী, পেকুয়া এবং টেকনাফের সেন্টমার্টিনসহ সমুদ্র উপকূলের অন্তত ৫০টি এলাকা বর্তমানে বৃষ্টি এবং জোয়ারের পানিতে প্লাবিত।
সবচেয়ে নাজুক পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে দ্বীপ উপজেলা কুতুবদিয়ায়। আলী আকবর ডেইল ইউনিয়নে কবি জসীম উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের পাশ দিয়ে ৫০ মিটার ভাঙা বেড়িবাঁধ দিয়ে ঢুকছে জোয়ারের পানি। এতে পূর্বপাড়া, সন্দ্বীপপাড়া, হাইস্কুল পাড়া ও শান্তি বাজার এলাকায় পানি জমে তিন ফুট পর্যন্ত প্লাবিত হয়েছে। কৈয়ারবিল ইউনিয়নের মৌলভী পাড়া ও মফজল আহমদ পাড়ার অন্তত ২০০টি বাড়িও পানিতে নিমজ্জিত।
উত্তর ধুরং ইউনিয়নের মিয়ারাকাটা এবং দক্ষিণ ধুরংয়ের বাতিঘর পাড়া এলাকায়ও ক্ষতিগ্রস্ত বেড়িবাঁধ দিয়ে পানি ঢুকে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় চেয়ারম্যান আলাউদ্দিন আল আজাদ।
কুতুবদিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ক্যথোয়াইপ্রু মারমা জানান, দ্বীপের অন্তত ৭-৮টি পয়েন্টে বেড়িবাঁধগুলো খুব ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডকে দ্রুত ভাঙা অংশগুলো মেরামতের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী জামাল মোর্শেদ জানান, কুতুবদিয়া, মহেশখালী ও পেকুয়াসহ বিভিন্ন এলাকায় অন্তত ২০টি বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং সেখান দিয়ে ঢুকে পড়া পানিতে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত।
অপরদিকে, বৈরী আবহাওয়ায় টানা চার দিন ধরে সেন্টমার্টিন দ্বীপের সঙ্গে টেকনাফের সব ধরনের নৌযান চলাচল বন্ধ রয়েছে। ফলে দ্বীপটি পুরোপুরি যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।
টেকনাফ-সেন্টমার্টিন রুটের সার্ভিস ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি রশিদ আহমদ জানান, প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে পণ্যবাহী ট্রলারসহ সব ধরনের নৌচলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে। ফলে দ্বীপে চরম পণ্যসংকট দেখা দিয়েছে।
সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের (ভারপ্রাপ্ত) চেয়ারম্যান ফয়েজুল ইসলাম জানান, দ্বীপে কাঁচাবাজার প্রায় শেষ। অন্যান্য ভোগ্যপণ্যও শেষ হয়ে যাচ্ছে। বাজারে কিছু থাকলেও তার দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে।
তিনি বলেন, দ্বীপের মানুষ এখন নিদারুণ অসহায়তায় দিন পার করছেন। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকার কারণে সাহায্য পৌঁছানোও সম্ভব হচ্ছে না।
টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ এহসান উদ্দিন বলেন, বৈরী আবহাওয়ার কারণে সাগর উত্তাল রয়েছে। ৩ নম্বর সতর্ক সংকেত বলবৎ থাকায় সব ধরনের নৌযান চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে।
এদিকে, টেকনাফ ও উখিয়ার পাহাড়ি এলাকায় অবস্থিত ৩৩টি রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরের অনেক অংশেও পাহাড়ধসের শঙ্কা দেখা দিয়েছে। প্রায় ১৩ লাখ রোহিঙ্গার মধ্যে একটি বড় অংশ এসব পাহাড়ের ঢালে ও নিচে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করছে।
স্থল নিম্নচাপের এই প্রভাবে সৃষ্ট দুর্যোগে উপকূলজুড়ে মানুষ এখন আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে। স্থানীয় প্রশাসন ও বিভিন্ন সংস্থা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কাজ করলেও আবহাওয়ার অবনতি অব্যাহত থাকায় দুর্যোগ আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
repoter