
ছবি: ছবি: সংগৃহীত
সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার যাদুকাটা নদীর ওপর নির্মাণাধীন শাহ্ আরেফিন ও অদ্বৈত মহাপ্রভু মৈত্রী সেতু দীর্ঘ সাত বছরেও সম্পন্ন হয়নি। সীমান্তবর্তী অঞ্চলের তিন উপজেলার মানুষ যে সেতুটিকে কেন্দ্র করে উন্নয়ন ও যোগাযোগ বিপ্লবের স্বপ্ন দেখছিল, সেই স্বপ্ন আজও ঝুলে আছে নির্মাণাধীন প্রকল্পের ফাঁকে। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২০ সালের মে মাসে, কিন্তু বাস্তবে এসে ২০২৫ সাল পেরিয়ে যাওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
জানা গেছে, যাদুকাটা নদীর ওপর নির্মিতব্য এই সেতুটির দৈর্ঘ্য ৭৫০ মিটার। প্রায় ৮৫ কোটি ৯৯ লাখ টাকা ব্যয়ে সেতু নির্মাণের দায়িত্ব পায় তমা কনস্ট্রাকশন নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। ২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাসে কাজ শুরু হলেও নির্ধারিত সময় ৩০ মাস পেরিয়ে প্রায় সাত বছর পার হয়ে গেছে। অথচ সেতুটির মাধ্যমে জেলা সদরের সঙ্গে তাহিরপুর, বিশ্বম্ভরপুর এবং মধ্যনগর উপজেলার যোগাযোগব্যবস্থা উন্নত করার পাশাপাশি পর্যটন ও বাণিজ্যিক সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচনের আশায় বুক বেঁধেছিল এলাকাবাসী।
সর্বশেষ পরিদর্শনে দেখা গেছে, ছয় মাস আগে সেতুর সব পিলারের কাজ শেষ হয়েছে। ১৫টি স্প্যানের মধ্যে ১২টি স্থাপন শেষ হয়েছে এবং ৭৫টি গার্ডারের মধ্যে ৬০টির কাজ শেষ হয়েছে। তবে এখনো বাকি আছে ৩টি স্প্যান ও ২০টি গার্ডারের কাজ। গত বছরের জুন মাসে একটি বালুভর্তি বাল্কহেডের ধাক্কায় একটি গার্ডার পানিতে পড়ে যাওয়ায় নির্মাণকাজে বড় ধরনের স্থবিরতা তৈরি হয়।
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি বলছে, বারবার বন্যা ও কোভিড-১৯ মহামারি সেতুর নির্মাণকাজে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে। এছাড়াও প্রয়োজনীয় নির্মাণসামগ্রীর সময়মতো সরবরাহ না পাওয়া বিলম্বের অন্যতম কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছে। তাদের দাবি অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে এবং বাকি অংশ শেষ করতে আরও এক বছর সময় প্রয়োজন হবে।
এই দীর্ঘসূত্রতার কারণে স্থানীয়দের মধ্যে ক্ষোভ বাড়ছে। তাহিরপুরসহ আশপাশের এলাকাবাসীর ভাষ্য, সেতুটির কাজ শেষ হলে এলাকাটি নতুন রূপ পাবে। তাহিরপুরের পর্যটন আকর্ষণ যেমন শিমুল বাগান, বারিক টিলা, যাদুকাটা নদী, শহীদ সিরাজ লেকসহ নানা দর্শনীয় স্থান সহজেই দেশের অন্যান্য স্থান থেকে পর্যটকরা ঘুরে দেখতে পারবে। একই সঙ্গে উন্নত হবে সড়কপথে পণ্য পরিবহন এবং ব্যবসায়িক কার্যক্রম। কিন্তু বছরের পর বছর পেরিয়ে গেলেও সেতুর কাজ শেষ না হওয়ায় হতাশায় দিন গুনছে তারা।
বাদাঘাট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নিজাম উদ্দিন জানান, যাদুকাটা নদীর ওপর নির্মিতব্য এই সেতুটি জেলার সীমান্ত এলাকার যোগাযোগে যুগান্তকারী ভূমিকা রাখবে। বর্তমানে যেসব মানুষ নদী পার হয়ে নৌকায় চলাফেরা করে জীবনের ঝুঁকি নেয়, তারা সেতুটি চালু হলে নিরাপদ ও দ্রুত পরিবহন ব্যবস্থায় যুক্ত হতে পারবে। তিনি মনে করেন, সেতুর নির্মাণকাজে বারবার গাফিলতি ও ধীরগতি প্রকল্প বাস্তবায়নের বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এদিকে প্রকল্প পরিচালক মিয়া মোহাম্মদ নাসিম স্বীকার করেছেন যে, একাধিক দুর্যোগ প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে। তাঁর মতে, বন্যা, করোনার প্রভাব এবং বাল্কহেডের ধাক্কায় একটি গার্ডার ভেঙে পড়া—সব মিলিয়ে সেতুর কাজ নির্ধারিত সময়ে শেষ করা সম্ভব হয়নি। তবে এখন কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে এবং আগামী বছরের এপ্রিল-মে মাস নাগাদ সেতুর কাজ পুরোপুরি শেষ হয়ে যাবে বলে তিনি আশাবাদ প্রকাশ করেন।
তাহিরপুর উপজেলা প্রকৌশলী (এলজিইডি) জাহিদুল ইসলাম জানান, প্রকল্পের নির্ধারিত মেয়াদ অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে। তবুও প্রকৌশল বিভাগ নিয়মিত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কাজ দ্রুত শেষ করতে তাগিদ দিয়ে যাচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটি জানিয়েছে, তারা ২০২৬ সালের মার্চ-এপ্রিলের মধ্যে সেতুর পুরো কাজ শেষ করতে পারবে।
এই দীর্ঘ বিলম্ব কেবল প্রশাসনিক দুর্বলতা নয়, বরং জনজীবনে ও অর্থনীতিতে সরাসরি নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে বলে স্থানীয় সচেতন মহল মনে করছে। একদিকে যেমন সীমান্ত এলাকার লোকজন এখনো নিরাপদ যাতায়াতের সুবিধা থেকে বঞ্চিত, অন্যদিকে পর্যটন শিল্পের সম্ভাবনাও কার্যত আটকে আছে অসমাপ্ত কাঠামোর ফাঁকে।
সেতু নির্মাণের প্রতিশ্রুতির সাত বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো সাধারণ মানুষের জীবনে তার বাস্তব রূপ নেই। বরং একের পর এক তারিখ পেছানোর খেলায় উন্নয়নের স্বপ্ন ভেঙে যাচ্ছে কাঁচের মত। সংশ্লিষ্ট মহলের কঠোর নজরদারি এবং প্রকল্প তদারকির অভাব হলে এই সেতুও হয়তো থেকে যাবে দেশের অগণিত অসমাপ্ত উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর দীর্ঘ তালিকায়।
repoter