
ছবি: ছবি: সংগৃহীত
কালো টাকা সাদা করার সুযোগ বজায় রাখা নিয়ে বাজেট প্রস্তাবনার তীব্র সমালোচনায় ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ
২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করে অন্তর্বর্তী সরকারের সমালোচনায় মুখর হয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। সোমবার (২ জুন) গণমাধ্যমে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে সংস্থাটি অভিযোগ করে বলেছে, প্রস্তাবিত বাজেটে যে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে তা রাষ্ট্রীয় সংস্কারের মূল উদ্দেশ্যের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। বিশেষ করে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সংস্কারকে সামনে রেখে যে প্রত্যাশা ছিল, তা বাস্তবে প্রতিফলিত হয়নি।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ অব্যাহত রাখা একাধারে অনৈতিক, বৈষম্যমূলক এবং সংবিধান পরিপন্থী। তিনি বলেন, ‘‘যেভাবেই ব্যাখ্যা করা হোক না কেন, এটি পরিষ্কারভাবে প্রমাণ করে যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দুর্নীতিবিরোধী সংস্কারের মূল লক্ষ্যকে উপেক্ষা করেছে। বরং এটি দুর্নীতিকে উৎসাহিত করে এবং রিয়েল এস্টেট লবির ক্ষমতার কাছে আত্মসমর্পণেরই ইঙ্গিত দেয়।’’
তিনি আরও উল্লেখ করেন, সংবিধানের ২০(২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো অনুপার্জিত আয়ের বৈধতা প্রতিরোধ করা। অথচ এই প্রস্তাবে স্পষ্টভাবে সেই সাংবিধানিক ধারার লঙ্ঘন ঘটেছে। তিনি বলেন, ‘‘এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে আবাসন খাতে অবৈধ অর্থের মালিকদের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা পাবে এবং যারা সৎভাবে উপার্জন করেন, তারা ফ্ল্যাট বা ভবনের মালিকানা পাওয়ার প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বেন।’’
টিআইবির মতে, সরকারের এ ধরনের সিদ্ধান্ত শুধু নীতিগত বিচ্যুতি নয়, এটি রাষ্ট্রীয় শুদ্ধাচার ও সুশাসনের ক্ষেত্রে উদ্বেগজনক একটি দৃষ্টান্ত। কালো টাকার বৈধতা দেয়ার মাধ্যমে সরকার কার্যত নাগরিকদের পুরো বছরজুড়ে অপ্রদর্শিত অর্থ অর্জনের জন্য উত্সাহ দিচ্ছে এবং বছরের শেষে সেই অবৈধ টাকাকে বৈধ করার অঙ্গীকার করছে বলে অভিযোগ করেছে সংস্থাটি। ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘‘যে খাতের সন্তুষ্টির জন্য এই বৈধতা দেয়া হচ্ছে, সেই আবাসন খাতই দেশের অন্যতম দুর্নীতিগ্রস্ত খাত হিসেবে চিহ্নিত।’’
সংস্থাটি দাবি জানিয়েছে, কালো টাকা বৈধ করার এই সুবিধা অবিলম্বে বাতিল করা উচিত এবং সংশোধিত বাজেটে এর সংশোধন এনে স্পষ্ট বার্তা দেয়া উচিত যে, সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে আপসহীন। সেই সঙ্গে কালো টাকার উৎস অনুসন্ধান করে দায়ীদের বিরুদ্ধে জবাবদিহি নিশ্চিত করার দাবিও জানায় টিআইবি। কর ব্যবস্থায় ন্যায্যতা ও সমতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কার্যকর কৌশল গ্রহণের প্রয়োজনীয়তার কথাও উঠে এসেছে বিজ্ঞপ্তিতে।
টিআইবির বিবৃতিতে বলা হয়, যদি সরকার দুর্নীতিবিরোধী অবস্থানকে বাস্তব ও কার্যকর বলে প্রমাণ করতে চায়, তাহলে কালো টাকা বৈধ করার যাবতীয় পথ চিরতরে বন্ধ করতে হবে। নচেত জনগণের কাছে এসব কার্যক্রম লোক দেখানো মনে হবে, যা দুর্নীতিকে স্বাভাবিক করে তুলবে এবং সুশাসনের যে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে তা বিশ্বাসযোগ্যতা হারাবে। বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়, বর্তমান সরকারের অধীনে গঠিত দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিশনও তাদের সুপারিশে কালো টাকা বৈধতার পথ চিরতরে বন্ধ করার কথা বলেছিল এবং এ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সর্বসম্মত মতামতও গঠিত হয়েছে। অথচ সরকারের সাম্প্রতিক অবস্থান সেই সুপারিশ ও ঐকমত্যের বিপরীতে গিয়ে আত্মবিরোধিতার প্রমাণ দিচ্ছে।
টিআইবি আরও বলেছে, অন্তর্বর্তী সরকারের বাজেট প্রস্তাবনায় একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যাশা ছিল—বিদেশে পাচার হওয়া বিপুল পরিমাণ অর্থ উদ্ধারে কতোটা অগ্রগতি হয়েছে, তার একটি স্পষ্ট ধারণা উপস্থাপন করা। কিন্তু অর্থ উপদেষ্টা মাত্র একটি বাক্যে এই বিষয়ে বক্তব্য শেষ করে দিয়েছেন। যেখানে বিদেশে অর্থ পাচারকারীদের ওপর কর ও জরিমানা আরোপের কথা বলা হয়েছে, সেখানেও তা বাস্তবায়নের পদ্ধতি স্পষ্ট করা হয়নি।
বাজেটে রাজস্ব আদায় বাড়াতে প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি নীতিগত কৌশল এবং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিতের পরিকল্পনাও অনুপস্থিত বলে মনে করছে টিআইবি। সংস্থাটির মতে, বাজেট বক্তৃতায় এসব বিষয়ে দিকনির্দেশনা না থাকা হতাশাজনক এবং তা দুর্নীতিবিরোধী নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
সবশেষে টিআইবি জোর দিয়ে বলেছে, একটি কার্যকর ও জনমুখী বাজেটের জন্য সরকারকে দুর্নীতিবিরোধী প্রতিশ্রুতি পূরণে আরও আন্তরিক ও সাহসী হতে হবে। কালো টাকা সাদা করার অনৈতিক সুযোগ বাতিল, দুর্নীতির উৎসে আঘাত এবং ন্যায্য করব্যবস্থা প্রতিষ্ঠাই হতে পারে জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধারের উপায়।
repoter